সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

খণ্ডগল্প: রক্তমাখা অশ্রু

https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/images/thumbs/ikhtamin_1392290494_1-ikhtamin_1392025659_1-ikhtamin_1391791542_1-stock-footage--x-blood-drops-landing-in-water-underwater-shot.jpg




রুমেলের ঈদের ছুটি এবার একটু তড়িঘড়ি করেই শেষ হয়ে গেল । শুক্রবার রাতেই ঢাকায় পৌঁছুল সে। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। টিভিতে খবর দেখছে। তিন দিন যাবৎ রূপাকে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কাইপ ফেবু কোনটাতেই নেই। তিন দিন পর আজ হঠাৎ রূপাকে পাওয়া গেল ফেবুতে।
-আমি তোকে অনেক অনেক মিস করেছি :'(
-আমি এই ক'দিন আমার মাঝে ছিলাম নারে...
-কই ছিলি
-হাই
-হ্যালো
-কোন সাড়া নেই
-কোন সাড়া নেই
-কোন সাড়া নেই
অতঃপর কোন সাড়া নেই
অপেক্ষা অনেক যন্ত্রণাদায়ক। তবুও রুমেল একটার পর একটা মেসেজ-ইমো-হাই-হ্যালো করেই যাচ্ছে... অপেক্ষার সাথে যেন তার বন্ধুত্ব জড়িয়ে গেছে।

-ওই
-জানিস। বাড়ি থেকে আসার সময় আম্মু আমের আচার বানিয়ে দিসে। আমার খুব মনে চায় তোকে দিতে। তুই কি আমাকে তোর আশেপাশের কোনও এ্যাড্রেস দিতে পারবি...? আমি কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিব। তুই কালেক্ট করে নিতে পারবি।

অনেকক্ষণ পর মিস রূপার সাড়া পাওয়া গেল
-আমের আচার নিয়া চলে আয়
রুমেল অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ফেবুতে পরিচয় রূপার সাথে। এইতো প্রায় আট মাস যাবৎ কথা হয় তাদের। ও হয়তো ভাবতেই পারেনি যে মিস রূপার সাথে তার সরাসরি দেখা হতে পারে কখনও। ও ভাবল হয়তো রূপা মজা করেই এমন বলছে
-কোথায় আসব
-বাড্ডা
-বাড্ডা কোথায়
-আমিন মার্কেট
-কিন্তু আমি যে দেখতে তেমন ভালো না। সুন্দর না। অসামাজিক। তোর সামনে আসব কেমনে? :(
-পিছন ফিরে আয়, সামনে আসিস না। গাধা কোথাকার...
-আমি সত্যি বলছি। তার উপরে আমি তো আনএডুকেটেড
- :P মাইর
-আসব?
-আয়
-আমি কিন্তু মিথ্যা কথা বলি নাই
-ওকে বুঝলাম

বাসায় একজন বড় ভাই আছেন. রুমেল তাকে বলল যে, একটু বাইরে যাচ্ছে.. ফিরতে দেরি হতে পারে..
-তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি. এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তুমি কই যাবে এখন?
-একটু বাড্ডা যেতে হবে.. এক রিলেটিভের কাছে।
-তুমি কি জানো.. দেশের কী পরিস্থিতি এখন!! আমি বিষয়টা ভালোভাবে দেখছি না. তারপরও যদি তুমি যেতে চাও সেটা তোমার মর্জি..

-ওই. আজই আসতে হবে? কাল আসলে হয়না? রাস্তা ঘাটের কী অবস্থা কে জানে!!
-হাহাহাহ. ওক্কে. ওক্কে. আসতে হইবনা
-আমার যেতে খুব মন চাচ্ছে. তবুও একজন বলল রাস্তায় প্রবলেম হতে পারে. বুঝতেছিনা কি করব...
-ওই আসবিনা
-ওইদিকটা কেমন আমার তেমন জানা নাই
-এত রাতে আসবিনা
-রাগ করেছিস?
-আরে না?
-না তুই মন খারাপ করেছিস. এখন গেলে আসার সময় প্রবলেমে পরতে পারি। কাল সকালে আসি? তুই ঘুম থেকে উঠার পর?
রূপার বোধ হয় আসলেই মন খারাপ হয়. তাই ওইপ্রান্ত থেকে কোন উত্তর আসেনা
-ওই... কই গেলি
-নিরবতা
-নিরবতা
-নিরবতা



অনেকক্ষণ পরে রূপার মেসেজ
-হুম ওকে.. যা ঘুমা.. গুডনাইট
-গুডনাইট

**************************************************
সকালে ঘুম থেকে জাগতে না জাগতেই রুমেল তার বসের কল পেল। তাকে বসের বাসায় যেতে বলেছে। যাহ. বোধ হয় আজ আর বাড্ডা যাওয়া হবেনা। বস একটা প্যাচের মানুষ। ১ ঘন্টার একটা কাজকে টেনে ৫ ঘন্টার বানিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই। রূপাকে গুড মর্নিং জানিয়ে বলল: একটু দেরি হতে পারে। যতদ্রুত সম্ভব সে বাড্ডা পৌঁছুবে।

বসের পিসিটার উইন্ডোজ রিকভারি করতে হলো। যত ঝামেলা সব এসে জমা হয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময়। ইতোমধ্যেই বেলা এগারোটা পেরিয়ে গেছে। আজ তার বারোটা বাজবে নিশ্চিৎ করেই বলা যায়। কোন রকমে একটা রিক্সায় করে সোজা চলে গেল শাহবাগ। শিশুপার্কের পাশটায়। এখানে অনেক ভালো ভালো ফুল পাওয়া যায়। কিন্তু ঈদ পরবর্তী এই সময়ে দোকানপাট যেমন সব খোলেনি, তেমনি ফুলের দোকানগুলোতেও তাজা ফুলের অভাব লকলকিয়ে ছড়িয়ে আছে। একটা দোকানেও ভালো লাল গোলাপ পাওয়া গেলনা। সব ফুল বাসি বাসি মনে হচ্ছে। ছোট ছোট দেখাচ্ছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা দোকানে গেল। এই দোকানের ফুলগুলো অন্য সব দোকানের তুলনায় কিছুটা ভালো। বেছে বেছে কয়েকটা ফুল নিল। দোকানি একটা তোড়া তৈরি করে ফেলল। রুমেল ফুলগুলো এমন ভাবে প্যাক করিয়ে নিল যেনো খোলার পর দেখা যায়। রূপা সারপ্রাইজড্ হয়ে যাবে। বাসে উঠে দেখে পেছনে কয়েকটা সিট খালি পড়ে আছে। ও গিয়ে জানলার পাশে বসল। রুমেল সব সময়েই জানলার পাশে বসতে আগ্রহী। কী বাসে। কী ট্রেনে। না, চলার পথে সে তেমন একটা ঘুমায় না। বাইরের দৃশ্য দেখতেই তার ভালো লাগে। রূপা এখন অফলাইনে আছে। ইনবক্সে একটা মেসেজ দিল- "আমি আসছি। বাসে আছি এখন।" একটু শঙ্কায়। রূপা যদি অনলাইনে না আসে.. তখন কী হবে..

বাসের সামনের দিক থেকে হঠাৎ হইচই শোনা গেল। একটু আগেই একজন মহিলা বাসে উঠেছিলেন। সিটের অভাবে তিনিও আরও কয়েকজনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এক ভদ্রলোক (!) মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে আছেন। অবশ্য তার সাথে তার ইয়ে-ও আছে। হেলপার সহ অন্যান্য যাত্রীরা তাকে যতই অনুরোধ করছে, সে ততই একগুয়ে সেজে বসে আছে। অবশেষে সে হেলপারকে ডাবল সিটের ভাড়া দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। হেলপার এবার বলে: খালাম্মারে আমি উঠতে নিষেধ করছি। সে জোর করে উঠছে। ইতোমধ্যেই অধিকাংশ যাত্রী উক্ত নরকলঙ্ক ভদ্রলোকের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন। কেউ কেউ তাকে (হাতের ভাষায়) কিছু বলার জন্য উঠেও পড়েছেন। এমন সময় বাস থামল মহাখালী ফ্লাইওভারের নীচে। উক্ত ভদ্রলোক মানে মানে তার ইয়ে-কে নিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। যাত্রীদের ভাগ্য ভালো যে, উক্ত ব্যক্তির গায়ে হাত লাগিয়ে হাতটা আর নোংরা করতে হয়নি। রুমেল বাস থেকে নেমে জানতে পারল আমিন মার্কেট খুব কাছে নয়। তাই একটা রিক্সা ডাকলো।

বাড্ডার আমিন মার্কেট অনেক বড় একটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। রিক্সা থেকে নেমে রুমেল দেখলো রূপা এখনও অফলাইন। মার্কেটের নিচে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সে। একটার পর একটা মেসেজ দিয়েই চলেছে রূপাকে। কোনও খবর নেই। অফলাইনে থাকলে হাজার মেসেজ দিলেও কোনও খবর হবার কথাও না। তবুও মনের শান্তনা। আহ বেচারা। অনেক ট্রাই করেও রূপাকে অনলাইনে পাওয়া গেলনা। ইশ.. আজ বড্ড গরম পড়েছে। রুমেল ঘামছে খুব। ঘড়িতে দু'টো বেজে গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার খুব খারাপ লাগছে। কেবলি ওর মনে হতে লাগলো- মিস রূপার বাসা হয়তো আশেপাশেই কোথাও.. অথচ রূপার এলাকায় এসে আজ তার সাথে দেখাই হবেনা হয়তো। ফুলগুলো মনে হয় এতোক্ষণে চুপসে গেছে। বৃথাই।

রূপার বান্ধবীদের সাথে ফেবুতে যোগাযোগ করে তার ব্যাপারে তেমন খোঁজ পেল না। খুব হতাশ হতে হলো তাকে। ও শুধু মনে মনে আশা করছে.. একটু সময়ের জন্য যদি রূপার সাথে দেখা হতো.... সব কিছু ঠিকভাবে হলে এতোক্ষণে রুমেলের ফিরে যাবার কথা। যাকগে.. তা আর হলো কই.. এদিকে ওর খুব খিদে পেয়েছে। পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট দেখতে পেল। একবার ভাবলো কিছু খেয়ে নিবে। আবার ভাবলো এই সময়টায় যদি রূপা অনলাইনে এসে থাকে। তাই আরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। বরং দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা দুটো ব্যাথা করে উঠল। কী আর করা.. ও রেস্টুরেন্টে ঢুকল। সংক্ষেপে কিছু নাস্তা সেরে নিল। ওদিকে মোবাইলের স্ক্রিনে বার বার তাকাচ্ছে। একটু পর পর পেজ রিলোড দিচ্ছে। উহু.. কোনও লাভ নেই। আবার বেরিয়ে এল আমিন মার্কেট মোড়ে। ওর বার বার মনে হয়, রূপা তার সাথে মজা করছে না তো আবার.. বলা তো যায়না.. রূপা যদি ইচ্ছে করেই তাকে এই তেমুহনীতে দাঁড় করিয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে মজা নিতে থাকে... এই ভেবে.. আশেপাশের বাসাগুলোর জানলায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ! তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। কিন্তু রূপা এই সময় অফলাইন কেনো.. এগারোটার সময়ও তো অনলাইনে ছিল সে.. তাছাড়া ও তো জানতো যে, রুমেল আসবে আজ। সে কি আসতে দেরী হওয়াতে অভিমান করেছে.. নাকি শুধুই ফান করার জন্য আসতে বলেছিল.. রুমেলের কিছুই বুঝে আসছেনা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার ঘুম পেয়েছে খুব। একটু পর পর মার্কেটে আর কতোক্ষণ পায়চারি করা যায়..

বিকেলের দিকে রুমেলের মনে হলো রূপার খালাতো বোনকে জিজ্ঞেস করলে কাজ হতে পারে.. সে শারমিন আপুর ইনবক্সে নক করলো.. কিছু সময় পরেই রিপ্লে মেসেজ এলো...

-তোমার কী খবর?
-এই তো আছি.. ভালোই..
-তা কী মনে করে..
-আপু.. একটা প্রবলেমে পড়ে গেছি
-তোমার আবার কী প্রবলেম হয়েছে..
-বলছি.. তার আগে বলো রূপার কোনও খোঁজ দিতে পারবে কিনা..
-ও ভালো আছে..
-তুমি কি তাকে একটু অনলাইনে আসতে বলতে পারবে..?
-ও তো এখন খুব ব্যস্ত আছে.. রাতে আসবে অনলাইনে..
রুমেল মনে মনে প্রমাদ গুণছে.. আজ তাহলে রাত অবধি দাঁড়িয়েই থাকতে হবে এইখানে। রোদ্রের প্রখরতা তেমন একটা নেই এখন। কিন্তু শরীর আর মানছেনা তার.. কী আর করা। সে একটু ভেবে বলল
-তুমি তাকে শুধু ২০ সেকেন্ডের জন্য অনলাইনে আসতে বলো.. তাতেই হবে.. প্লিজ..
-স্যরি.. আমি পারবো না।
-প্লিজ আপু.. আমি একটা জায়গাতে এসে আটকা পড়েছি.. তুমি তাকে শুধু আমার কথা বলো.. ও ঠিকই বুঝবে..
-আচ্ছা.. একটু দাঁড়াও..
-ওকে

-রুমেল.. আমি আসলেই দুঃখিত.. সে এখন বাসায় নেই। একটু আগেই তার বান্ধীর সাথে বাইরে গেছে.. তোমাকে চলে যেতে বলেছে..
কথাটা জানার পর যতটুকু খারাপ লেগেছে রুমেলের, তার চেয়ে বেশি অবাক হলো সে। এই রকম কিছুর আশা করেনি ও।
কিছুক্ষণ পর আরেকটা মেসেজ আসলো-
-শোনো, তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাওতো..
-০১২২৬৯৭৪৭৯৮
-ওয়েট
-ওকে.............

কিছুক্ষণ পরেই রুমেলের মোবাইলে রিং বাজতে শুরু করলো। দুরু দুরু বুকে সে সবুজ বাটনটা চেপে কানে ঠেকালো।

-হ্যালো..
-কই তুই?
-এই তো.. কী যেনো বলে এইটাকে.. ওহ.. আমিন মার্কেটের সামনে আছি
-এমন পাগলামি কেউ ক..রে... ? (কণ্ঠে অনুরাগের মিশ্রণ)
রুমেল অপ্রস্তুত হয়ে যায়..
-মানে!
-বলছি.. এমন পাগলামি কি কেউ কখনও করে??
-কী করলাম আমি..
-কেউ আসতে বললেই তুই চলে আসবি?.. কাজ-কর্ম ফেলে এভাবে কেউ সারাটা দিন অপেক্ষায় থাকে?
-আর তুই আসতে বলেছিলি.. তাই চলে এলাম..

সহসা রুমেলের মনে হলো ফোনটা শারমিন আপুরও তো হতে পারে.. তাই সে বলল: কে? শারমিন আপু?
-লাত্থি খাবি.. আমি রূপা..
রুমেল হেসে ফেলল.. ও যেনো এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা.. ওর নিরবতায় ছেদ ফেলে রূপা জিজ্ঞেস করলো: কই দেখা করবি?
রুমেল উল্টো প্রশ্ন করলো: কোথায় আসবো?
একই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি শোনা গেল রূপার কণ্ঠেও.. ব্যঙ্গ করছে.. যেনো এমনটা হবার কথা (জায়গা নির্ধারণের ভার রূপাকে দেয়া) সে আগে থেকেই জানতো..
-আমি একটু বেরিয়েছিলাম তো.. বাসা থেকে দূরে চলে এসেছি.. তুই এক কাজ কর.. গ্রামীণফোনের সামনে চলে আয়..
-আচ্ছা.. আমি আসছি

রুমেল দ্রুত একটা রিক্সায় চড়ে বসলো। ফাঁকা রাস্তায় রিক্সা এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ওদিকে রুমেলের হার্টবিটও বেড়ে চলেছে ক্রমশঃ।

রূপার হঠাৎ মনে হলো.. রুমেল তার সাথে গেম খেলছে নাতো আবার! নাকি রূপাকে শুধু শুধুই গ্রামীণফোনের সামনে যেতে হবে। শেষে দেখা যাবে, রুমেল আদৌ আসেনি। তাই সে আবার ফোন করলো রুমেলকে।

-হ্যালো..
-কই তুমি
-আমি আসছি.. রিক্সায় আছি..
-কোন পর্যন্ত আসছো?
-এখন বড় একটা মসজিদ পার হচ্ছি
-ওকে.. চলে আসো.. আমিও প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি..
-আচ্ছা

গ্রামীণফোন এর সামনে নেমে রুমেল ভবনটার কোণাকোনি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা ইতস্তত ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে যেনো খুঁজছে। আবার গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে মোবাইলের বাটনগুলো চাপছে। যেনো কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামলাচ্ছে। মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো। রূপার কল।

-হ্যালো
-তুই কই এখন?
-গ্রামীণফোনের নিচে বা পাশে কোণায় দাঁড়িয়ে আছি।
-কালো একটা শর্ট পাঞ্জাবী পরা?
-হুম..
-ওকে দাঁড়া.. আমি আসছি।

একটু পরেই রুমেল দেখলো ওর পেছন দিক থেকে দু'জন মেয়ে আসছে। হাস্যরস করছে তারা। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ওরা। পরিচিত চেহারাটা খুঁজে নিতে কোনও সমস্যা হয়না তার। মিস রূপাকে বাস্তব চিত্রে তার ছবি থেকে আরও অনেক অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। অপরূপা। কিন্তু জীবনে প্রথম কোনও মেয়েকে কিছু দিতে আসা রুমেল আজ নিজেকে খুব লাজুক আর অপ্রস্তুত আবিষ্কার করে। তাই সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রূপাকে না চেনার ভান করে। কাছে এসে রূপা তাকে জিজ্ঞেস করলো:
-কীরে কেমন আছিস?
আজন্মের হাস্যোজ্বল মুখে ফিক করে হেসে ফেলে রুমেল। বলে..
-খুব ভালো আছি.. কিন্তু তুমি রূপা?
-হ্যাঁ.. আমিই রূপা। কেনো? চিনিসনি আমাকে?
জড়তা কাটিয়ে রুমেল বলে
-চিনবোনা কেনো? চিনেছি তো..
রূপার সঙ্গে আসা মেয়েটি তার নাম বলল, রুমেলও নিজের নাম বলল, আমি চয়ন..
রুমেলকে থামিয়ে দিয়ে রূপা বলে..
-নাহ.. ওর নাম "রুমেল" বলেই এক গাল হেসে ফেলে
রুমেল আচার ও ফুলের প্যাকেটটা রূপার হাতে দিতে দিতে বলে “এটা রাখো”। রূপা অমনি প্যাকেটটকা মুড়ে ছোট করে নিতে চাইলে রুমেল বাধা দিয়ে বলল- ভেতরে একটা জিনিস আছে.. ওটা ভেঙ্গে যেতে পারে..
-আচ্ছা.. ওই তুই এভাবে চলে আসলি কেন? আমি ভাবতেই পারিনি তুই আসবি..
-তুমি আসতে বলেছিলা.. তাই আসলাম.. নইলে কি আর আসতাম! দুপুরে খেয়েছো?
-আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম.. কিছুক্ষণ আগে জেগেছি.. তখন খেয়েছি। তুই দুপুরে খেয়েছিস? মনে হয় খেতে পারিসনি..
-আমি খেয়ে নিয়েছি
এরই মাঝে রূপার বান্ধবী কোথায় যেনো চলে গেলো
-আসলে আমি বুঝতে পারিনি তুই আসবি.. আমিতো আগেই বেরিয়ে পড়েছি.. একটা জায়গায় যাবার কথা ছিল
-ওহ.. তুই না করে দিলেই তো হতো.. আমি ফিরে যেতাম।
-তোকে একটা কথা বলা হয়নি.. তুই কি মাহফুজকে চিনিস?
-কোন মাহফুজ?
-ওই যে ব্লগার মাহফুজ..
সুবিদিত যশস্বী ব্লগার মাহফুজুর রহমান মাহফুজের কথা প্রায় সকলেই এক বাক্যে জানে। তাকে চিনেনা এমন মানুষ খুব অল্প। রুমেল ব্লগার হলেও অতোটা নয়। অল্প পানির ছোট মাছের মতো, গভীর জলে যার আনাগোনা নেই।
-ওহ.. হ্যাঁ.. চিনি তো.. কী হয়েছে?
-জানিস.. আগামী শুক্রবার তাকে আমি বিয়ে করছি...

কথাটা রুমেলের কোথায় গিয়ে যেনো বিঁধলো.. বুঝতে পারছেনা ও।
-তাহলে তো ভালোই.. শুভ বিবাহ' এই বলেই রুমেল হাসলো কিছুক্ষণ
-কিরে.. এইভাবে হাসছিস কেন.. আশেপাশের মানুষ তোর দিকে তাকিয়ে আছে..

-তোমার বাবা-মা'র পছন্দ আছে বলতেই হবে.. আমিও তোমাকে আশির্বাদ করছি.. মাহফুজ অনেক ভালো ছেলে.. জীবনে অনেক সুখী হবে তুমি
-আরে ধুর.. বাবা-মা আপাতত জানবে না.. পরে জানাবো..
-মানে কী? তাহলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে না?
-জটিলতাই চাইছি আমি.. হাহাহ...
-দেখো.. যেভাবে ভালো মনে করো তুমি..
-ওই.. এখন যাই? পরে কথা হবে..
-আচ্ছা.. ভালো থেকো..

সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমের ভবনগুলোর ওপাশে। সন্ধ্যা নেমে গেছে একটু আগে। বাস চলছে। আজ রাস্তায় জ্যাম নেই। আধঘন্টায়ই বাসায় পৌঁছানো যেতে পারে। রুমেলের ফোনটা বাজছে। রূপার কল।
-হ্যালো...
-তোকে অনেক অনেক অনেক অনেক স্যরি
-কেনো?
-তোকে ঠিক মতো সময় দিতে পারিনি.. তাই।
-কী যে বলো না.. এতে স্যরি বলার কী আছে! আমি কিছুই মনে করিনি।
-আচ্ছা..
-আচ্ছা.. ভালো থেকো.. রাখি.. পরে কথা হবে..


মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠেছে বাস। দূরের বাসা-বাড়িগুলোর হাজার হাজার সান্ধ্যবাতির আলো ঝিকমিক করছে। দেখতে ভালোই লাগছে। যেনো জোনাকীর মেলা। আঁধারের মাঝে আলোগুলো হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো। অপরিচিত কিছু শব্দের সৃষ্টি হলো। রুমেল বাসের মাঝামাঝি একটা সিটে বসেছিল। সেখান থেকে সে উড়ে সামনের দিকে চলে এলো। বাসের কিছু যাত্রী জানলা দিয়ে বাইরে ছিঁটকে পড়লো। কারও জানা ছিলনা, এই বাসের চালক কিছু আগেই এর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে । দুর্বার ভঙ্গিতে ছুটে যাওয়ায় দ্রুতগতির বাসের কাছে ফ্লাইওভারের রেলিং কিছুইনা। চোখের পলকে রেলিং ভেঙ্গে গেল। কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে পাক খেতে খেতে একটা বিল্ডিংয়ে গিয়ে আঘাত হানল বাসটা। অতঃপর দুমড়ে মুচড়ে নিচে পড়লো। রুমেলের কোথাও তেমন লাগেনি। শুধু কোথা থেকে একটা রড এসে তার বুকে গেঁথে গেছে। ডান চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা লাল রঙা অশ্রু গড়িয়ে নেমে এলো। রক্তাশ্রু।

১৯.১০.২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন