সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০১৪

অ স মা প্ত চি ঠি

   




ফেরার আগে বহু আগের সেই চিলেকোঠায় একবার ঢুঁ মারতে ভুললাম না। জং ধরায় পুরানো তালাতে চাবি কাজ করছে না। অবশ্য এতো দিনে চাবিতেও মরচে পড়ে গেছে। তালাটা ভাঙতে হলো। ভেতরের ভ্যাপসা বাতাস প্রতিবাদ করে উঠলো। গুমোট গন্ধের ধাক্কায় আমি পেছনে সরে আসতে বাধ্য হলাম- যেনো কয়েক যুগ ধরে ওরা মুক্তির জন্য হাঁসফাঁশ করছিলো বন্দিখানায়। পুরোটা ঘরে মাকড়সার রাজত্বই চোখে পড়ছে। করিমকে বলে ভেতরটা পরিষ্কার করালাম।

কোথায় যেনো কয়েকটা ছবি রেখেছিলাম। ছবিগুলো খুব দরকার ছিলো। ওগুলো পাওয়া গেলো সিন্দুকে। একটা হলুদ খামও পেলাম। প্রেরকের নাম, ঠিকানা কিছুই লেখা নেই। প্রাপকের অংশ পড়ে বুঝতে বাকি রইলোনা, সে একজন মেয়ে। চিঠিটা পড়ার লোভ সামলাতে পারলামন না।


তাতে লেখা–

“এখনও
একটু একটু করে
তোমার কথা আমার মনে পড়ে।
খুব মনে পড়ে।
অস্পষ্ট
আবার অনেক স্পষ্ট
তোমার স্মৃতিরা আমার ভাবনার জগতে আঘাত হানে
বেশ এলোমেলো করে দেয় আমাকে
গভীর রাতে
অথবা পার্কের বেঞ্চিতে
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে
একলা পেলে
তারা আমায় লতার মতো জড়িয়ে ধরে
শত চেষ্টায়ও আমি ছাড়াতে পারিনা
সেইসব ভাবনার জট; চিন্তার জাল
আমায় তারা নিয়ে যেতে চায়
কয়েক যুগ পেছনে

বাগান বাড়ি।
শিমুল আর সাদা গোলাপের গাছ। এক সারি শিমুল রেখা তো আরেক সারি গোলাপের সমাহার। বাগানের দক্ষিণে একটা চার-চালা ঘর দাঁড়ানো। ইটের দেয়াল, পাকা ভিটি। দেয়ালটা উজ্জ্বল সবুজ আর উপরের টিনের চাল আলোকিত লালে মিশেছে। বাড়ির পেছনে বড়ো একটা পুকুরও বুঝি আছে। পরিষ্কার পানি তার। দেখতে কী চমৎকার।

ফুটন্ত সাদা গোলাপের পাশে
                                 ফুল ঝরানো শিমুল গাছের নিচে

দোলনাটা দুলতে থাকে
আগের মতোই
মানবশূন্য
তোমায় দেখিনা কোথাও
তোমায় খুঁজে পাইনা কেন?
কেবল আধো আধো ভাবনার জাল
সর্পিল
দেখতে সবুজ ও ফ্যাকাসে
আলোক রঙের টিয়া পাখি সেজে
কুসুম কুমারীর বাগান জুড়ে
উড়ে উড়ে ঘুরে
তোমার অপেক্ষায়
অনন্তকাল
যেনো
এইখানে তার ঘর
এখানেই তার বাস

এক ঝাঁক চড়ুই উড়ে যায়
বাতাসের ঝাপটা লাগে
শিমুলের বুড়িয়ে যাওয়া শরীরে
কয়েকটা মরা পাতা
শুকনো পাতা
ঠিক তার পায়ের কাছেই ঝরে পড়ে
চির বিদায়ের আগে আশীর্বাদ নেয় তারা
তাদের মৃত্যু হয়েছে আজ
আমি চেয়ে থাকি উদাস দুপুরে
অথবা ক্লান্তি ঢাকা বিকেলে
আমিও মরতে চাই তাদের মতো
কিন্তু আমি যে পাতা নই
আমি তো পাখি
বেঁচে থাকি কারও অপেক্ষায়
কিন্তু এই অপেক্ষার কোনও শেষ নেই
মুক্তি আছে
আমি পরিত্রাণ চাই
                        একবার
                                  শুধু একটি বার
আমি সুযোগ চাই
আমি আমায় হত্যা করবো
আমিই আমাকে মুক্তি দিতে পারি
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়

তারপর
কেটে গেছে কতো কাল
বিদায় নিয়েছে অনেক বসন্ত
এসেছে বহু বরষা, কতো ঝড়
শিমুলের কতো মরা পাতা
সমাধিস্থল থেকে খোয়া গেছে
প্রবল হাওয়ায়,
আহা সাদা গোলাপ
বৈধব্যে প্রাণ বিসর্জন হলো তার
পুরানো তরু, গুল্ম-লতা শ্যামলিমা
বাবুই চড়ুই টিয়া শ্যামা
বসন রঙ সবই বদলায়
কেবল একটি পাখির অপেক্ষায় রূপান্তর ঘটেনি
দোলনাটা দুলতে থাকে
আগের মতোই
মানবশূন্য

তবুও
আমি বেঁচে আছি
আজও
          নির্লিপ্ত
আত্মহনন করবো বলে
শুধু একটি বার
নিজেকে হত্যা করতে চাই”

পৃষ্ঠা শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু চিঠির লেখা এখানেই শেষ? না আরও কিছু বাকি ছিলো, ঠিক বোঝা গেলো না। অপর পাতায় কিছুই নেই। চিঠিতে কারও নাম নেই। তারিখ নেই। নেই কোনও সম্বোধন।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন