শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

গল্পটা এমনও হতে পারেঃ পরাবাস্তব

ব্যালকনির পাশে একটা নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে। বাড়ির অন্য গাছগুলোর চাইতে এই গাছটা তুলনামুলক খাঁটো। মৃদু শব্দে নারকেল পাতারা ঝিরঝিরিয়ে দোল খাচ্ছে। চিকন-লম্বা পাতাগুলোর শেষ প্রান্ত বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটা ফোঁটা উড়ে এসে ইভানার চেহারায় জলজ তিলক পরিয়ে দিল। ও বসে ছিল তৃতীয় তলার বেলকনিতে। শ্রাবণের শেষ বৃষ্টি একটু আগেই ঝরিয়ে দিয়ে গেছে প্রকৃতি। আরও একটা বর্ষা পেরিয়ে গেল। একটু পরেই শরতের প্রথম ভোর। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ইভানা ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে উঠে গেল স্টাডি রুমের দিকে। আলমিরা থেকে বহুদিনের অব্যবহৃত পুরানো ডায়েরিটা বের করল। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে একটা চেয়ার টেনে বসল। মেঝেয় ঘষা লেগে শুকনো কাঠ ক্যাচ্... শব্দ ছড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে। ইভানা এই আওয়াজটার সাথে খুব পরিচিত। ও একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। শরীর শিরশির করে তার এই আওয়াজ কানে গেলে। আজও ব্যতিক্রম হলনা। একটা বাজে শব্দ। দাঁতে দাঁত চেপে কটকট শব্দ তুলছে সে। অনেকদিন পর আজ সে একটা চিঠি লিখবে। রাসেলকে। কতো-দিন হলো চিঠি লেখেনা। ডায়েরির সব ক'টা পাতা হলদেটে রূপ ধারণ করেছে। খসখসে পাতাগুলো তার দিকে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্ত হয়ে। তার লেখনির আঁচড়ে যেন একটু খানি মসির পরশ অতৃপ্ত কাগজের পিয়াস মেটায়.. ঢুলুঢুলু চোখে ঘুম নেমে এলো। চিঠি আর লেখা হলো না তার..

ইভানা তার সেই চিঠিটা লেখার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে। আর কখনও সে চিঠি লিখবেনা বলে স্থির করেছে। কারণ, রাসেল নেই এখন আর। ইভানার জীবন থেকে রাসেল দূরে, বহুদূরে, অনে-ক দূরে চলে গেছে। তাই চিঠি লেখার প্রশ্নই আসেনা। তবুও তার মায়া লাগতো সেই অব্যবহৃত ডায়েরিটার দিকে তাকালে।
একদিন। সে ওটা পূনরায় আলমিরাতেই উঠিয়ে রাখে। কিন্তু তার ঘুম যেন হারিয়ে যায় কোনও অচিনপুরে। সে ঘুমুলেই ডায়েরিটা স্বপ্নে এসে দেখা দেয়। তার হলদে পাতাগুলো যেনো ঢেবঢেব করে চেয়ে থাকে ইভানার দিকে। ডায়েরির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইভানা রেগে যায় খুব। ওটার প্রকোপ থেকে বাঁচতে সে কোনও একদিন বিকেলে তাদের বাংলোর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে ফেলে দেয়। ডায়েরিটা ভেসে যায় স্রোতের ডানায় ভর করে। চলে যায় অচিনপুরে। হয়তো বা। রাসেলের মতোই কেউ একজন তা তুলে নেয়। অথবা পানিতে ভিজে পচে যায় তার পাতাগুলো।
ইভানা এখন আর স্বপ্ন দেখে না। দেখেনা কোনও দুঃস্বপ্ন..
দীর্ঘ দশ বছর পর। ইভানা পূনরায় সেই ডায়েরিটা স্বপ্নে দেখতে লাগল। নতুন করে। সে মনে করতে লাগল। ডায়েরির সাথে তার কিসের এতো সম্পর্ক!!! ভেবে পায়না সে। সারাক্ষণ তার মাথায় শুধু একই চিন্তা খেলা করে। ডায়েরিটা তাকে আবার কষ্ট দিচ্ছে কেনো...
একদিন তার খেয়াল হলো- ফেলে দেয়া সেই ডায়েরিটা তাকে রাসেল দিয়েছিল। কোনও এক বোশেখি মেলার বিকেলে। অথবা কোনও ভালোবাসা দিবসের সন্ধ্যায়। হ্যাঁ... ডায়েরির প্রথম পাতায় রাসেলের লেখা একটা কবিতাও ছিল। খুব মনে পড়ছে কবিতাটা। ওটাতো তার মুখস্থ-ই হয়ে আছে অনেক দিন ধরে। রাসেল কি তাহলে তার জীবনে আবার ফিরে আসবে! নইলে এতোদিন পর আবার তার স্মৃতি কেন তাড়িয়ে ফিরছে দশ বছর আগের থেমে যাওয়া পুরানো ইভানা'কে?
ইভানা অন্তত এতটুকু বুঝতে পারল- এই ডায়েরিতে কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে। যা অপার্থিব। এতো-বছর পর যখন ওটা আবার তার পিছু নিয়েছে, তার মনে হতে লাগলো- ডায়েরিটা এখনও অক্ষত রয়েছে। আর তা হয়তো বা কাছেপিঠেই কোথাও আছে। অথবা শীঘ্রই রাসেলের সাথে তার দৈবাৎ যোগাযোগ হয়ে যেতে পারে।
তাতে কী... ইভানা তো এখন অনেকটা ভুলেই গেছে রাসেলকে। যে তার জীবন থেকে সরে গিয়েছিল। রাসেল অষ্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর টাউন্স ভিলে'র এলিজা নাম্নী একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। দেখতে ব্ল্যাক স্কিনের হলেও মেয়েটা দেখতে নাকি খুব চমৎকার। বিষয়টা জানার পর বেশ মর্মাহত ও মনক্ষুন্ন হলেও পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নেয় ইভানা। রাসেলের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে না। থাকনা। রাসেল যদি নিজের জীবনকে আপন করে সাজিয়ে নিতে চায়, সুখী হতে চায়, তাহলে ওর বাধা দেবার কী-ই-বা আছে। রাসেল থাকুক তার নিজের মতো করেই। নিজের ভুবনে। এতো-দিনে সে রাসেলকে প্রায় অপিরিচিতের অবস্থানেই রাখতে শুরু করেছে। যেন আদৌ তাদের দেখা হয়নি! তাছাড়া এখন সে নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ভীষণ ব্যস্ত আছে। আপাতত একটা থিয়েটার পার্টিতে যোগ দিয়েছে সে। ওই সব রাসেল টাসেলের খাওয়া নেই তার কাছে। আপাতত বিয়ে-শাদির ব্যাপারেও তার কোনও মত নেই। পরিবারকে না করে দিয়েছে। যদিও কিছুটা বুড়িয়ে যাচ্ছে। তাতে তার মাথা ব্যথা নেই। রাসেলকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছে তার আগে থেকেই ছিলনা। কিন্তু সেই রাসেলই যখন তাকে আঘাত দিল। রাসেলকেও সে ক্ষমা করতে পারছে না। মাঝে মাঝে রাসেল তার ফেবু-তে মেসেজ পাঠায়। ই-কার্ড গিফট দেয়। কিন্তু সেগুলো ইভানা ওপেন করে দেখারও দরকার মনে করে না। মেসেজ গুলো না পড়েই মুছে ফেলে। তবুও কেনো জানি রাসেলকে ব্লক করার কথা তার মাথায় ঢুকে না।
কিছুদিন যাবৎ ইভানা লক্ষ্য করছে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সে রাসেলের মেসেজগুলো এখন দেখে। পড়ে। কয়েকদিন রেখে তার পর ডিলিট করে। এমন তো ছিল না ও। তবে কি সে রাসেলকে এখনও ভুলতে পারেনি? এটা ভেবে ও নিজের উপরেই ক্ষিপ্ত হয়। নাহ. ও রাসেলকে ক্ষমা করতে পারবে না কখনও। ভালোবাসবে না আর তাকে। সে তো অনেক আগেই মরে গেছে।

দিন দিন ইভানা অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক যুগ পূর্বে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া সেই পুরানো ডায়েরিটা আবারও সে স্বপ্নে দেখে। স্বপ্ন নয়। বলা যায় দুঃস্বপ্ন। ডায়েরির হলদে রঙ ধারণ করা লেখার পোষাক বিহীন অভুক্ত পাতাগুলোর দিকে তাকালে তার ভয় লাগে। আতঙ্কিত চোখ দুটো নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে লাফিয়ে ওঠে প্রায়ই। তার মনে পড়ে ডায়েরিটা তাকে রাসেল-ই দিয়েছিল। কোনও এক বোশেখি মেলার বিকেলে। অথবা কোনও ভালোবাসা দিবসের সন্ধ্যায়। ক্রমশঃ সে নিদ্রাহীনতায় ভুগতে শুরু করে। যা তার প্রাত্যহিক জীবনে অনেকটাই প্রভাব ফেলে। তার চোখ দুটোর নিচে কালি জমে যায়। দিনদি তার মেজাজ খিটমিটে হতে থাকে। কারও সাথেই তেমন একটা ভালো ব্যবহার করে না। মানসিক অবসাদ তাকে ঘিরে ধরে। প্রতি রাতেই ডায়েরির পাতাগুলো তাকে নিদ্রায় হানা দেয়। প্রবল মেন্টাল প্রেসারে সে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ করে। আশপাশের অতি চেনা জানা মানুষগুলোকেও তার সহ্য হয় না অনেক সময়ে। অনেকের হালকা রস বাক্যেও সে এখন মন্দ খুঁড়ে পায়। তাকে কেউ ভালো পরামর্শ দিলে সে ক্ষেপে যায়। অল্পতেই অনেক রেগে যায়। পাশাপাশি ইদানিং তার স্বভাবেও পরিবর্তন এসেছে। নিজেকে সে সেলিব্রেটি ভাবতে শুরু করেছে। যদিও তা সে নয়। অহংকারে তার পা যেনো মাটি স্পর্শ করতে চায় না। কোনও সহকর্মী বা জুনিয়র কেউ যখন সুন্দর পারফর্মেন্স করে পঞ্চমুখী প্রশংসায় মুগ্ধ, তখন ইভানা তীব্র হিংসার বশে বাহ্-বা প্রাপ্ত ওই ছেলে/মেয়েটিকে গালাগাল দিতে থাকে। এই সব অস্বাভাবিক আচরণে বিরক্ত ও চিন্তিত হয়ে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে যখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেয়ার কথা তোলে, তখন সে তাদের মন্দ কথা শুনিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না।

ইভানা ভেবেছিল- এই ডায়েরিতে কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে। যা অপার্থিব। তাই সে ওটা স্বপ্নে দেখে। মূলতঃ তার ধারণা ছিল ভুল। সে সারাদিন রাসেলের কথা ভাবতো, ডায়েরির কথা ভাবতো। তাই তার সঙ্গে এমন হতো। ঘুমের মাঝেও ডায়েরি দেখতে পেতো। কিন্তু তখন ভয় পেতো সে।

২০০৯ সালের একুশে বই মেলায়। কাকতালীয়ভাবে তারিখটা ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। রাসেল দেশে এসেছে গত কয়েকদিন হলো। ইভানা কে জানানো হয়নি। ভাবছিল সারপ্রাইজ দেবে তাকে। রাসেল কয়েকটা বই কিনে সান্ধ্য নাটক প্রদর্শনীর গ্যালারির দিকে এগিয়ে গেল। আজকের নাটক "মেঘ বালিকা" প্রদর্শিত হচ্ছে। মঞ্চে খুব পরিচিত একটি মুখ দেখে তার মনে একটা ঢেউ খেলে গেল। ইভানার মুখোমুখি হবার এটা একটা সুযোগ বলা যেতে পারে। আজই সে ইভানার সাথে দেখা করবে। প্রদর্শনীর প্রতি তার কোনও খেয়াল নেই। সে সময় গুণছে। কখন নাট্যসভা শেষ হবে। মনে মনে প্ল্যানগুলো বার বার রিহার্সেল করে নিচ্ছে। কীভাবে ইভানার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে। কেমন করে কথা শুরু করবে। তার অপেক্ষার সাথে সাথে সময়ও যেনো গড়িয়ে চলছে। সময়ের দূরত্ব ধীরে ধীরে কমছে। কিছুক্ষণ পরেই নাট
শেষ হবে...

---------------------------------------------------------

এরপর কী হতে পারে.. পাঠক নিজের মতো করে ভেবে নিতে পারবেন.. যার যার মতো করে.. নিজের পছন্দসই একটা দৃশ্য.. তা হতে পারে মহা মিলন.. হতে পারে চির বিদায়.. অথবা অন্য কিছু....

উপরের গল্পের সাথে কারও বাস্তব জীবনের সাথে আশা করি মিলবে না। তবে ইভানা ও রাসেল জুটির সাথে অল্প কিছুদিন আগেই আমার পরিচয় হয়েছে। স্টোরিটা পুরোপুরি-ই ভিন্ন ধাঁচের। শেয়ার করতে চাইনা। অনুমতি নেই। শুধু এতটুকু বলি- বয়ফ্রেন্ড এস আই রাসেলের অকথ্য অত্যাচার আর নির্যাতন সইতে না পেরে ইভানা এখন প্রতিবাদি ও কার্যকরি পদক্ষেপ নেবার দ্বারপ্রান্তে.. তার জন্য আমাদের শুভ কামনা করা উচিত..

 

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন