বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

পোড়া মাটি


মা.. ওমা.. উঠো। ভাত দু’টা খেয়ে নেও। আমি পানি নিয়া আসি” বলে পুষ্পা কলসি হাতে কলপাড়ের দিকে হেঁটে গেলো। আজ চারদিন পর জ্বরাক্রান্ত কমলা দেবী ধীরে ধীরে তিক্ত খাবার খেতে শুরু করলো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সদানন্দ বাবু কিছু ট্যাবলেট এনে দিয়েছিলো। তা-ও প্রায় শেষের দিকে। জ্বর কিছুটা কমলেও শরীর খুব শীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে ভাসছে। নিজের অজান্তেই কমলা দেবী'র মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- এটাই কি ছিলো আমার কপালে? একই সাথে তার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। যেন ভয় পেয়ে শিউরে উঠছে।


--------------------------------------------------------------------------
স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে সদানন্দের ছোট পরিবার। এক কথায় সচ্ছল ও সুখীই বলা যায় তাকে। কলেজ গেটে একটা ফটোকপিয়ারের দোকান আছে তার। এক শাটারের ছোট দোকান হলেও তা থেকে যতোটুকু আয় হয় ওই দিয়েই তার দিন কেটে যায়। কখনও কারও কাছে ঠেকতে হয়নি তাকে। মেয়েটা এইবার উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিবে। সদানন্দের স্বপ্ন- পুষ্পা একদিন অনেক বড় হবে। অনেক বড় ডাক্তার হবে। তাই ওকে চোখে চোখে রাখে। আদুরে পুষ্পার এমন কোনও আবদার নেই যা সে পূরণ করেনি।


বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বাবুর। দেশে কী একটা অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। একটি দল ক্রমাগত হরতাল-অবরোধ দিয়েই যাচ্ছে। অগ্নি সংযোগ করছে চলন্ত বাসে । ইঁদুরের মতো কেটে কেটে ফেলে রাখছে রেলপথে লোহার সুতোগুলো। আর এতে সহায়তা করছে পাকিস্তানপন্থি একটা জংগি সংগঠন। মানুষ আতংকে রাস্তায় নামতে পারে না। তারা ভয়ে বাসে চড়ে না এখন। কখন আবার আগুন লাগানোর মহড়া শুরু হয়ে যায় তা তো কেউ বলতে পারেনা। সেদিন নাকি ঢাকায় কোন স্কুলের সামনে রাখা ট্যাক্সিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা। তাও আবার ছুটির দিনে। জুমার নামাজের সময়। স্কুলের বাচ্চারা পরীক্ষা দিতে যেতেও ভয় পায় এখন।


এক সপ্তাহ হলো দোকানের ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়েছে সদানন্দ। আয় নেই। বেতন দিবে কেমনে। বলে দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হলে তাকে খবর দিয়ে ডাকিয়ে আনবে। নিজেই যে চলতে পারেনা। তাকে এখন খুব হিসেব করে ব্যয় করতে হয়। সারাদিন দোকান খুলে বসে বসে মাছি তাড়ানোর মতো অবস্থা তার। প্রিন্ট-ফটোকপি’র কাজ এখন খুবই অল্প। ব্যবসার এমন আকাল বিগত বছরগুলোতে আর দেখেনি সে। এমন সময় এলাকার মনছুর কামালকে সদানন্দের দোকানে পা রাখতে দেখা গেলো।
- "আরে সদানন্দ.. কেমন আছো? দিনকাল চলে কেমন?"
- "আজ্ঞে না স্যার। লোকজন নাই। কাস্টমারও নাই। তবুও ভগবানের কৃপায় বেঁচে আছি।"
- "তাই নাকি! আমার কিছু কাজ হতে পারে। করে দিবা?"
- "আজ্ঞে স্যার। পারবো না কেন? কাজ না করলে খাবো কি করে!"
- "দেখো তো এই সিডিতে কিছু ফাইল আছে। কত পৃষ্ঠা হতে পারে..."
সদানন্দ সিডিটা অপেন করে দেখে অনেকগুলো পিডিএফ ফাইল। সময়ের ব্যাপার..
- "স্যার আপনে রেখে যান। আমি হিসেব করে আপনাকে জানাবোনে।"
- "ওকে, তাহলে ফাইলগুলো কপি করে রাখো। হারায়না যেনো.. এগুলাই প্রিন্ট করায়ে ফটোকপি করাতে হবে।"
- "আজ্ঞে স্যার।"
- "সবগুলো ফাইলের পৃষ্ঠা সংখ্যা একটা হিসাব করে আমাকে জানাবা।" আর এগুলা প্রিন্ট প্লাস ফটোকপি বাবদ কতো টাকা লাগবে তাও জানাবা, বুঝলা?
- "জি স্যার।"
সদানন্দ ভেবে দেখলো- ১৯৫৬২ পৃষ্ঠা এক সপ্তাহের মধ্যে প্রিন্ট করে আবার তা ফটোকপি করা সম্ভব নয়। তার চেয়ে ভালো হবে দুই সেট করে নরমাল প্রিন্ট করবে। মনছুর সাহেব তাকে দশ হাজার টাকা এ্যাডভান্স করেছে। বাকী ত্রিশ হাজার টাকা কাজ শেষে দিবে। ভদ্রলোক এরশাদের শাসনামলে টানা দুই বারের এমপি। এবারের দশম নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছে। এরশাদ নির্বাচনে না গেলেও মনছুর কামাল ঠিকই নির্বাচনে লড়বে। তার প্রতিপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। রয়েছেন। সদানন্দকে দেয়া ফাইলগুলো ভোটার তালিকার কপি ছিলো।

- “কীরে করিম! খবর কী, জানিস?”
- “কী হইসে আবার!”
- “মনসুর তো ভোটার লিস্ট ছাপাইতেছে।”
- “কস্ কী.. হালায় তাইলে নির্বাচনে যাইবো! এত্তো অবরোধ দিলাম তয় কার লাইগ্যা?” হতাশা ঝরে পড়ে করিমের কণ্ঠ থেকে।”
- “হু.. সদানন্দ পাইছে কাজটা। দেখলাম প্রিন্ট বাইর কইরা টাল দিয়া রাখতাছে। শুন.. এক কাজ করি। আইজ রাইতে মালুর দোকান পুড়াইয়া দিলে কেমন হয়?”
- “না.. পুড়াইলে সবাই ভাববো আকামডা আমরাই করছি। এর চাইতে ভালো হইবো নির্বাচনডা আগে শেষ হোক। দেখি কোন দিকের পানি কোন দিকে গড়ায়। তাছাড়া মালুর দোকান পুড়াইলেও মনসুর হালায় অন্যখান থিকা প্রিন্ট করাইবো। লাভ নাই।”
- “হে হে হে, নির্বাচন কইরাও হেগো কুনু লাভ নাইক্যা। বিদেশীরা এই নির্বাচন মানবো না। তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন দেওন লাগবো। আর বিএনপি নির্বাচনে আসা মানেই ক্ষমতায় আসা। তখন লাভের গুড় আমরাই খামু। ঠিক কইছি না!” বলেই চাতুর্যের ভাব নিয়ে মতি স্থানীয় জামায়াত নেতার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
- ধুর... তুই তো হালা একটা আবাল। আর বিএনপি একটা গাধার দল। দেখস নাই এরশাদের লগে কী খেলাটা খেলছে। শেষে তো এরশাদই পল্টি লইল। মাম্মা আসলেই একটা কড়া মাল।” একটু থেমে করিম আবার বলে- ‍‍"ময়দানে স্বশরীরে হাজির থাইকা অবরোধ সফল করি। তাগোরে খুশি করি। তারাই যদি ক্ষমতায় যাইয়া আমাগো ভুইলা যায়, তখন কী হইবো রে মতি, আমি তো সেই টেনশনেই আছি।"
- ‍"আরে ধুত... তোরে আমরা নেতা বানাইয়া মস্ত ভুল করছি। তোর মাথায় গোবর ছাড়া কিছুই নাই। তুই কি ভুলে গেছিস- আমাদের পিছে কার হাত আছে। আমাগো কিছুই করতে পারবো না কেউ। আমরা বাংলাদেশের অস্থি-মজ্জা খাই বিদেশের টাকায়। ওই সব অহন বাদ দে। পুলিশে খুজতাছে তোরে, হেইডা আবার ভুইলা যাইস না। আপাতত আর বাইরে ঘুরিস না। আমরা তো আছিই। চৌধুরীদের গাড়িতে আগুন দিছিল ফরিদ। চৌধুরী তোর নামেই মামলা ঠুকছে।"


ঢাকায় নাকি গতকাল অনেক গণ্ডগোল হয়েছে। সমাবেশের নামে সেখানে জামায়াত-বিএনপির লোকেরা পিকনিকের আয়োজন করতে গিয়েছিলো। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া নতুন গণতন্ত্রের ডাক দিয়েছে। সে আর তার উপরওয়ালা জানে ওটা কোন ধরণের গণতন্ত্র। অবরোধের কারণে ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বটে। মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো নানান কথা মানুষের কানে কানে বাসা বাঁধছে। বিএনপি নাকি যে কোন মূল্যেই হোক, এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দিবে না। বাবু বুঝতে পারছেনা সামনের দিনগুলো তার কেমন হবে.. কী ঘটবে দেশে, নির্বাচন হবে তো.. দেশ শান্ত হবে তো... পরিবার নিয়ে একটু শান্তিতে বাস করতে পারবে কি? বিকেলে মনসুর সাহেব লোক পাঠিয়েছিলো। সে ভোটার তালিকার প্রিন্ট কপিগুলো নিয়ে গেছে। সদানন্দকে আরও দশ হাজার টাকা দিয়ে বলেছে বাকি টাকা নির্বাচনের পর পরিশোধ করবে। তিনি এখন নির্বাচনী প্রচারণায় ভীষণ ব্যস্ত। এই শঙ্কাটাই করেছিলো সদানন্দ। নির্বাচনকালীন পাওনা নগদে উসুল করতে হয়। কিন্তু সে তা করতে পারেনি। বিশ হাজার টাকা এই মুহূর্তে তার অনেক কাজে আসতো।


৫ জানুয়ারি'র কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ। ভাসমান শিশির বিন্দু বহনকারী বাতাস আর ক্লান্ত দুপুরের মলিন সূর্যটা বার বার অলস দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বিএনপিমনা কিছু মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়নি। তারা ভোট দিবে না। অনেকেই জামায়াত-শিবিরের বোমাতঙ্কে ভোট দিতে যেতে পারছে না। পথের মোড়ে ওরা ওঁত পেতে আছে। এরা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে ম্যানহোলের নোংরা কীটের মতো, ওগুলো যেভাবে রাস্তার চারিদিকে গড়াগড়ি খায়। পুলিশ নাকি এদের টিকির নাগাল পায় না! তবুও কিছু মানুষ গায়ে চাদর চড়িয়ে; কাঁথা মুড়ি দিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। কেউ কেউ প্রেয়সীর সঙ্গে লেপ-কম্বলের নিচে শুয়ে শরীরটা উষ্ণ করার চেষ্টায় লিপ্ত। সকালেই গ্রামবাসী শুনতে পেয়েছিলো- রাতে হাসানপুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটা ভোট কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে দূর্বৃত্তরা। খবরটা মৃদু আতংকের ছায়া ফেলেছিলো ঠিকই, কিন্তু তা স্থায়ী হতে পারেনি।
দুপুরের পর থেকেই কেন্দ্রগুলোতে একটু একটু করে জনসমাগম বাড়তে শুরু করেছে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও নির্বাচনী এজেন্টরা নড়ে বসেছেন।

এবারের নির্বাচনটা কেমন যেনো অসময়ে সংঘটিত হলো। শীতকালের নির্বাচন তো শীত কাঁপিয়ে যায়। ভোট দেবে, না শরীরে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া নেবে তাই ভাবনার বিষয়। না, একটা ভোট দেবার জন্য শীত কোনও বাঁধা হতে পারে না। তাহলে!! বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় অনেক আসনে প্রার্থী নির্বাচিত হলেও বাকী আসনও কম ছিলনা। কিন্তু পৌষের হাওয়া তেমন একটা শীতেলও না। হিমেল বাতাসের চেয়েও অনেক বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত-শিবির এর আতংক।
এরা এদেশের জন্য অভিশাপ। এরা না থাকলে আজ বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা শান্তিতেই থাকতে পারতো।
কিন্তু বিকালের চিত্র সকালের সম্পূর্ণ বিপরীত। আগুনের ভয়কে জয় করে গ্রামের মানুষজন ঠিকই ভোট কেন্দ্রে এসেছে। ভোট দিয়ে নিরাপদেই ফিরে গেছে তারা। সদানন্দ ভোট দিয়েছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মনোয়ার হোসনকে। নৌকাই যে এখন একমাত্র ভরসা। গত পর্বে লীগ সরকার ভালো অনেকগুলো কাজ করেছে।
হ্যাঁ.. নৌকা ভরসার প্রতীক। তাছাড়া ধানের শীষ এবারের নির্বাচনে নাই। থাকলেও তার দিকে কেউ মুখ তুলে তাকাতো না। ধানের শীষ জনগণকে কী দিয়েছিল মনে করতে পারছেনা সদানন্দ। তবে তার স্পষ্ট মনে আছে- নৌতা গতবার স্কুল-কলেজ নির্মাণ, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, দূর্গতদের ত্রাণ, কৃষককে সারসহ আরও অনেক কিছুই দিয়েছে। আর নাঙ্গলে ভোট দেবার প্রশ্নই আসেনা। তার তো চাল-চুলোরই ঠিক নেই। জনগণের করবে কী! ভোটটা তাহলে নৌকাতেই গেল।


কুয়াশার চাদরে ঢাকা দূরের আকাশ গাছপালার আড়ালে মাটির সাথে মিশে গেছে। সাঁজের আঁধারে গাঁয়ের মানুষ রজনীবাসের বন্দোবস্তে ব্যস্ত। পড়ার ঘরে পুষ্পা একটা অংক কষছে। সদানন্দ তার দোকানের হিসাব সম্পন্ন করে বাড়ির ফটকে পা রাখতে রাখতে ভাবলো- কালই যোগাযোগ করতে হবে মনছুর সাহেবের সাথে। আগামী মাসের দোকানের ভাড়ার ব্যবস্থা হয়েও যেতে পারে। বেচারা নির্বাচনে সফল হতে না পেরে বেশ কিছুদিন কারও সাথেই মিশে নি। আজ ফোন করে দেখা করার জন্য বলেছে।

দেয়ালের পাশের কিছু শুভ্র অঞ্চল দেখলে যে কেউ ভাববে সেখানে ময়দার গুড়ো ছড়ানো হয়েছে। সদানন্দও তাই মনে করলো। কিন্তু সে জানে না- এই বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে আজ সে যতো দেরি করবে, তার জন্যে ততোই মঙ্গল।
কমলা দেবী সদানন্দের জন্যে জলখাবার সাজাচ্ছেন আর সদানন্দের চোখে মোটা ফ্রেমে বাঁধানো চশমা। সামনে খোলা ‘শ্রী মদভগবদগীতা’।

ধ্বংসপ্রায় বাড়ির পাশে ছোট্ট রান্নাঘর। এই পাকের ঘরে একটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃতি কাকে কখন কোথায় নিয়ে ঠেকায় তা কেউ অনুধাবন করতে পারে না। সেদিনের দূর্ঘটনার ধকল কমলা দেবী সইতে পারেন নি। নির্বাক। একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়েও তার অন্তরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে সাজানো গোছানো সোনার সংসার তছনছ হয়ে যাওয়ার বেদনায়। কী করে এমন হলো তার কিছুই মনে নেই তার। সেদিন জানালার শার্সি ভেদ করে ছুটন্ত আগুনের লতা ঘরের ভেতরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দূর থেকে লক্ষ্য করলে যে কেউ মনে করতো ওদের পুরো বাড়ি যেনো একটা অগ্নিকুণ্ড। প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলিম সবাই পানি ভরা বালতি নিয়ে দৌড়ে এসেছিলো বাবুর বাড়িতে। তারা ভুলে গিয়েছিলো ধর্মের বেড়াজাল আর জাতের বিভেদ। এক আদমের সন্তান, এটাইতো ওদের বড়ো পরিচয়। কাছের ইঁদারা থেকে কয়েকজন বালতি পূর্ণ করে দেয় আর বাকিরা সেই পানি নিয়ে আগুন নেভানোর প্রচেষ্টায়। যদিও ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু সরকারি পানি আসার অপেক্ষায় বসে থাকলে চোখের সামনেই সবকিছু ছাই হয়ে যেতো। পাশের বাড়ির স্কুল পালানো চঞ্চল কিশোর ইলিয়েছ। সে কয়েকটা চটের বস্তা ভিজিয়ে ভেতরে নিক্ষেপ করে নিজেও দু’টো ভেজা বস্তা গায়ে জড়িয়ে ঢুকে গিয়েছিলো আগুনবাড়ির ভেতর।

--------------------------------------------------------------------------
অসুস্থ মায়ের জন্যে পানি নিতে এসে পুষ্পা ভুলেই গেলো কি করতে হবে! চাপকলের ধারে দাঁড়িয়ে সে শিমুল গাছের ডালে বসা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই পাখিরা মুক্ত জীবনের বাহক। মনে হয় ওদের কোনও দুঃখ নেই। আহা, আমি যদি এই পাখির মতো মুক্ত হতে পারতাম! পুষ্পার ভাবনারা ডালপালা গজাতে পারে না। দু'টি হাত ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে আরেকটি হাত। মুখ ও হাত-পা বাঁধা পুষ্পার চোখ যেনো কোটর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে করিমের হাতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু গোঁ-গোঁ শব্দ করা ছাড়া আর কিছু ওর করার নেই।

মতি খুব যত্ন সহকারে এসিডের বোতলের সবটুকু পুষ্পার মুখমণ্ডলে ছিটিয়ে দেয়। ওদিকে চামড়া গলা বুদ্বুদ দেখে করিমের চোখের হিংস্র চাহনি হায়েনাকেও হার মানাবার মতো। তিন প্যাকেট গান পাউডার ছড়িয়ে রাখে পুষ্পার শরীরে। হতভাগা মেয়ের জীবন্ত লাশ পোড়ানোর সাক্ষি হলো ম্যাচের একটি কাঠি। জীবনের সাধ মিটে গেলো পুষ্পার, যে একদিন স্বপ্ন দেখতো বড়ো ডাক্তার হবে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে।

শিমুলের ডালে কোনও পাখি নেই। এই নিষ্ঠুরতা ওরা দেখতে চায় নি। ওরা সইতে পারবে না মানুষের ওপর এই অত্যাচার।



পুনশ্চঃ একটা গোষ্ঠী আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে ছিল। আজও আছে। এদেশের মাটিতে ওরা বিষাক্ত শূল বিঁধিয়ে রেখেছে। জামায়াতে ইসলামী। ওরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কখনও মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ওরা আজও স্বীকার করেনা। এদেশের খেয়ে, এদেশের পরে ওরা গুণগান গায় পাকিস্তানের। সংগঠনের নামের সাথে ইসলাম শব্দ যুক্ত করলেও ওদের কার্যবিধি সব ইসলাম ধর্ম বহির্ভূত। অথচ যে কোনও তুচ্ছ বিষয়েই ওরা ধর্মকে টেনে আনে। কোথাও ঠেকলে ধর্মকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে ওরা সিদ্ধহস্ত। বেচারা ধর্মও ওদের পণ্য হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুতেই সফল হতে না পেরে ওরা এখন নয়া কৌশলে নেমেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে একটা সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদি ও তালেবানি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। দেখতে দু’পা বিশিষ্ট গৃহপালিত হিংস্র প্রাণী হলেও দশম নির্বাচনের পর ওরা ক্ষেপাটে পাগলা কুকুরের চরিত্রে মাঠে নেমেছে। ওরা খুঁজে খুঁজে নিরীহ হিন্দু এলাকাগুলোতে হামলা চালিয়ে ঘর-বাড়ি ভাঙচুর করেছে। অসংখ্য মানুষের বাড়িতে আগুণ দিয়েছে। ওরা কী চায়? ওরা চায় বাংলাদেশ বহিঃবিশ্বে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপরে নির্যাতনকারী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হোক। কিন্তু আমরা তা হতে দিতে পারিনা। আমাদের উচিত এই সব দু’পেয়ে জংলিগুলোকে প্রতিহত করা। দেশকে, দেশের মানুষকে রক্ষা করা। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সকলেই মানুষ। জংলি জানোয়ারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে মানুষেরই এগিয়ে আসতে হবে।


উৎসর্গঃ যে সকল নারী সত্ত্বা আজ পৃথিবীর বুকে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার

৮ মার্চ, ২০১৫

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন