বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬

ক্লেশ

http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/ikhtamin/04-2015/ikhtamin_115418087552b69b5707ad8.74076390_xlarge.jpg

রোমেন একটা জরুরি ফোন করবে এমন সময় তার মুঠোফোনটা বেজে উঠলো।
- হ্যালো, মা! কেমন আছেন?
- এইতো আছি। ভালা। তুঁই কেমন আছো?
- আমি ভালো আছি।
- দুপুরে খাইছো নি?
- হ্যাঁ খাইছি। আপনি খাইছেন?
- হ। আর হুনো... লামিসার কোনও খবর জানো নি?
- হ্যাঁ... এক ঘন্টা আগেও তো কথা হইছে, বললো ভালোই আছে।
- আর কিছু কয় নো?
- বলছে। গতকাল নাকি তাহমিনার কাছে অনেক বার কল দিছে। কেউ রিসিভ করে নাই। পরে ব্যাকও করে নাই কেউ। আজকে ফোন করে দেখে কল ওয়েটিং। কেমন মানুষ। আমি বাড়িতে গেলে ওদের বাড়ি বেড়াতে যাবার জন্য শতবার ফোন করে, অথচ এতোদিন হয়ে গেলো আমাদের কাছে ফোন করাতো দূরের কথা, কল দিলেও ধরে না। ওকে। আমরা আর কল করবো না। লামিসারেও বলে দিছি- আর যেনো কল না করে ওর কাছে।

রোমেনের কথাগুলো জ্যোৎস্নার মনে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি বলেন- ‍"হুনো... তাহমিনা তো আঁর কাছে সকালে ফোন করছে। দুই মিনিট কতা কই কাডি দিছে। অন আঁই কই লাইমিসার আর কোনও খবর জানো নি?
- না তো!
- কাইল লামিছার মাথা হাডাইয়ালাইছে। তোঁয়ার কাছে কয় নো?
- না, আমার সাথে তো এই ধরণের কোনও কথাই বলে নাই।
- আঁইও তো জাইনতাম না। কানিজের আম্মা ফোন করি কইছে। আঁই গেছি আরে হইলা অস্বীকার কইচ্ছে। হরে বাড়িয়ালি কয়- এ্যাই মেয়ে। মিথ্যা কথা বলো কেন? তোমার মাথা ফাটে নাই?
- আপনি ওর বাসায় যাওয়ার পরে তার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেন নাই?
- না, হিগ্যার জামাই বেলে খুলি হালাইতে কইছে। মাথাত বেন্ডিজ থাকলে মাইনষে বেলে জিগাইবো- কেমনে এরুম ওইছে। মাথার পিছে ফাটছিলো। ওন চুলের লাই দে-য়া যায় না।
- ফাটছিলো কীভাবে?
- হিগ্যা কয় রাগ করি নিজের মাথাত নিজে হাতুড়া দি বাড়ি দিছে। আর হিগ্যার জামাই কয় পা হিসলাই চিত্তি হড়ি মাথা হাডাইছে।
- তারপর? এখন কী খবর?
- কাইল রাইত এই ঘটনা ঘইটছে। হরে বাড়িয়ালির সহযোগিতায় লগে লগে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে লই গেছিল। হেতারা বেন্ডিজ করি ফেক্সিশন (প্রেসক্রিপশন) দি দিছে।"

আরেকটা কল এলো।
- সাইফুল কোথায়? রোমেন ভাই!
- উনি তো অফিসে নাই, বিডিআরসিএস-এ গেছে।
- ‍"ধূর, হালার পোলা হালা, তার *য়রে আমি চু*। একটা অর্ডার দিছি রবিবারে, আজ বুধবার হয়ে গ্যালো এখনো ডেলিভারী দিতেসে না। এখন সে আমারে বকা শুনাচ্ছে। তার অনেক কাজ আছে ঠিকাছে। ও না করলে বলে দিবে যে- আমি করবো না- ল্যাও*র বা*।" কথাগুলো এক শ্বাসে বলে গেলো রহমান।
- ওনার মোবাইল কি বন্ধ?
- হ্যাঁ?" শুনতে পায়নি, তাই যেনো খেকিয়ে উঠলো
- ওনার কি নাম্বার বন্ধ?
- আরে ও একটা ফাউল। কল দিতাছি রিসিভ করতিছে না। ওরে কাজ দিছি রবিবার। আজকে হইলো যাইয়া বুধবার।
- ওহ হো..." রোমেন কিছু বোঝার ভান করে।
- আজকে ব্যাংকের লোকজন আমারে বকাঝকা করতেছে। ওর *য়রে আমি চু*। হালার ব্যাবসার *য়রে আমি চু* দেবোনে খা**র বাচ্চা বাই*চো*।
- আচ্ছা আমি দেখি। আমি ওনাকে ফোন করে দেখি- যোগাযোগ করা যায় কি না।
- আচ্ছা ঠিকাছে, ওরে বলবেন- রহমান ভাই ফোন দিতে বলছে।
- আচ্ছা ঠিকাছে।

রহমান সাহেব এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেকদিন হলো জড়িত। সবাই জানে- তার গালমন্দের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু সে অল্পতেই রেগে যাবার লোক নয়। বোশেখ উপলক্ষ্যে ময়নামতি ব্যাংকের গ্রেটিং কার্ড তৈরী করতে হবে। এজন্য কয়েকটা ডিজাইন ফার্ম– যাদের কাছ থেকে ইতোপূর্বে উক্ত ব্যাংক বিভিন্ন কাজ করিয়েছিলো– ওদেরকে ডিজাইন প্রস্তুত করতে বললো। কালার ক্রিয়েশনের ৪ টা ফাইল জমা পড়লো। সাইনভ্যালির জমা পড়লো ৬ টা আর শমি কায়সারের ধানসিঁড়ির ৯ টা। এতোগুলো থেকে টিকলো সাইনভ্যালির একটা। কিন্তু মুদ্রণ ঝামেলায় ময়নামতির কার্ডগুলোর ডেলিভারি শিডিউল এলোমেলো হয়ে যায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমরান সাহেবসহ আরও অনেকেই উচ্চবাচ্যসহ বকে দিয়েছেন ঠিকাদার রহমান সাহেবকে। সেই ঝাল তিনি মিটিয়েছেন গাল পেড়ে। কী আর করবে বেচারা। ছোট্ট এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাইফুল অথবা ভারপ্রাপ্ত কেউ যদি রহমানকে ফিডব্যাক করতো, তাহলে রহমানও ব্যাংকে ফিডব্যাক জানাতে পারতো। আজকাল আবার সাইফুলের কী হয়েছে, কে জানে! কখন কী করছে বা কী বলছে সবই যেনো পরে ভুলে যায়। লোকটার মনে হয় মাথা নষ্ট হয়ে যেতে চলেছে।

-----
এই পর্যন্ত লেখার পর আমার মাথায় আর কিছু আসছিলো না। খানিক জিরিয়ে নিতে হবে। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। ডেকের রেলিংয়ে ভর দিলে দেখা গেলো পদ্মার কালো পানি। ফেনা তুলে ছুটছে পেছনের দিকে। দূরে-বহুদূরে সরে যাচ্ছে দ্রুত। মানুষের জীবনে এমন হাজার হাজার খেদ জমানো থাকে। সময়ে সময়ে ওগুলো বুদ্বুদাকারে ভেসে ফেনার রাজত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু আমাদের জলযানকে বিদায় দেয়া নদীর ফেনার মতো সরে যায় না। দ্রুত নয়। ধীরেও না। তাই হয়তো মানুষ নদীর ধারে যায়। যেনো মনো মাঝে স্তূপিকৃত কষ্ট থেকে কিছুটা কমাতে পারে। কিছুটা দুঃখ যদি ফেলে আসা যায় সীমাহীন জলরাশির বুকে। আমি প্যাকেট থেকে জিনিসটা বের করে খানিক আগুনে মাথাটা পোড়ালাম। কাজটা প্রায়ই আমি করে থাকি। অনেক দিন পর পর। মনটা যখন অনেক ভালো থাকে। অথবা যখন মন মহাশয়ের অবয়ন অশান্তির কালিমায় চুবে থাকে। অবশ্য এখন সে কোন অবস্থানে রয়েছে তা ঠিক বুঝতে পারছিনা আমি। ধূর... অতো বোঝাবুঝির সময় নেই। আমি বরং ছোট্ট বস্তুটায় চুম্বন বসাই। ছোট্ট টানে কিছুটা ধোঁয়া আমার ভেতরে প্রবেশ করাই। ফুরফুরে বাতাসেরা আমার নাসিকা রন্দ্র পেরিয়ে সেই ধোঁয়ার সঙ্গে মেশে আলিঙ্গনে। আমি টের পাই- বাতাসে জলের গন্ধ। মন্দ নয়। আমার অনেক ভালো লাগে। অনেক।


নাহ... লেখাটা শেষ করতে হবে। কোনও রকমে অংবং লিখে হলেও। অসমাপ্ত লেখাদের আটকে রাখতে নেই। ওরা ভীষণ কষ্ট পায়। অভিসম্পাত করতে থাকে তার স্রষ্টাকে। তখন সেই মুখপোড়া স্রষ্টার মানসিক ভাবনাগুলোও অনিশ্চয়তার জঞ্জালে বন্দি হয়।

- হ্যালো... মা...
- কী?
- আমি এখন লামিসার সাথে কথা বলছি।
- কী কয়?
- ও নাকি নিজেই মাথা ফাটাইছে। রফিকুলের সাথে কী নিয়া ঝগড়া হইতেছিলো। আর রফিকুল দেয়ালে তারকাঁটা বসাইতেছিলো মনে হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে রফিকুল ওরে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় বাড়ি দেওয়ার ভয় দেখায়। তখন লামিসা রাগ করে বলে- তুমি বাড়ি দেয়ার দরকার নাই। আমি নিজেই পারমু। রফিকুল বলে- তাইলে দেছ না ক্যা? তখনই রাগে-অভিমানে লামিসা এইরকম করে। বাড়ি লাগে মাথার পিছে। ফাইটা যায়। অনেক রক্ত ঝরছিলো।
- ওপাশে নিশ্চপ।
রোমেন আবার বলে যায়- "প্রেসক্রিপশনে 'পুলিশ কেস' লেখা ছিলো। এই কারণে নাকি রফিকুল ওইটা লুকাইয়া ফেলছে। আমারে বলছে এসব যেনো কেউ না জানে। রফিকুল যদি বুঝতে পারে এসব আমরা জানি তাইলে আবার ওরে বকাবকি করবো।
- এলাকার মানুষ ভিতরে ভিতরে বে-কে জানে। সবাই কয়- হুজুর মানুষ ওই কেমনে এরুম বউরে মাইত্তে হারে। এডাতো মাতাল রিকসাওয়ালাত্তনও খারাপ।" একটু থেমে জ্যোৎস্না আবার বলেন- এর আগেও দুই-তিনবার ঠাস্ ঠাস্ করি চোবাড় লাগাই দিছিলো। মাইয়ার গালের ভিত্তে কাডি সিসসিরাই রক্ত বারইছিলো। আঁই তো তোগো কাছে কিচ্ছু জানাইনো।"
রোমেন এবার ক্ষেপে যায়- ‍"আমি তো আগেই না করেছিলাম চরুয়া এই ছেলের কাছে বিয়ে দিতে। "
- হেসুম তো ধার্মিক আর হুজুর দে-ই বিয়া দিছি। এরুম ওইবোয়ান কি জাইনতাম নি? সব আঁর কোয়ালের দোষ।"
- তাইলে এখন আর কী করবেন। এককাজ করেন- আলমগীর স্যারকে জানাইয়া রাখেন। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হইলে তখন কাজ হইবো।
- না, অন না। লামিসা কইছে আরও কিছুদিন দেখবো। হের হরে জানাইবো। হেসুম যা করার কইরবো।
- আজ তো মাথায় বাড়ি পড়ছে। আরেকদিন গলায় ছুরি পড়বো। আর নইলে যেদিন দড়িতে গলা ঝুলবো সেদিন জানাইবেন?
- আঁই তো লামিসারে চলি আইতো কইছিলাম। হিগ্যা কয়- হিগ্যা যদি কষ্ট করি থাকতো হারে আমগো সমস্যা কী? এল্যাইয়েনা আঁই চুপ করি রইছি।
- কিন্তু ও এতো বোকা কেন? ও কি পাগল যে, ঝগড়া করে নিজের মাথা নিজেই ফাটাবে? এখন তো তারই ক্ষতি হইছে!!!

--------
এমন মেয়ে আমাদের দেশে অনেক আছে। ওদের স্বামী সবার সাথেই ভালো আচরণ করে। লোকের সামনে মেয়েটার সাথেও মধুর আচরণটাই করে থাকে। কিন্তু আড়ালে নানাবিধ নির্যাতনে চিড়েচেপ্টা বানিয়ে ফেলে। তা হতে পারে শারিরিক নির্যাতন, অথবা হতে পারে মানসিক।

তবুও আমাদের বলতে হবে-
নব দিনে নব সাজে নব বিকিরণে
হর্ষ-উল্লাস আনুক স্বস্তি এই মন প্রাণে
নব সুর খুঁজে পাক নব নব গানে
সব দুখ ধুয়ে সুখ আসুক জীবনে।।


আশা করি আজ সবার নববর্ষ শুভ হয়েছে... 

১৪ এপ্রিল, ২০১৫

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন