প্রথম প্রকাশঃ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:৫৬
সামহোয়্যারইন ব্লগ
আমি পূজা। বয়স ২০। অবিবাহিত। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। বাড়িতে আমার একমাত্র মা আছে। তাঁর দেখাশুনা আমাকেই করতে হয়। আমি একজন গ্রার্মেন্টস কর্মী। সাভারের রানা প্লাজার একটা গ্রার্মেন্টস কোম্পানীতে কাজ করতাম। মোটামুটি ভালোই কাটছিল দিনকাল। কিন্তু এটাও বোধ হয় ভাগ্যের সহ্য হলনা। ভাগ্যটা যেন আমাকে কষে একটা চপেটাঘাত করল। গত ২৪ এপ্রিল সকালে গার্মেন্টসে গিয়ে দেখি গেইটের বাইরে অনেক মানুষ। আমারই মতো সবাই শ্রমিক। তাদের চোখে-মুখে ভয় ও বিরক্তি উভয়টাই দেখতে পেলাম আমি। কয়েকজনকে দেখলাম চলে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। ওরা বললো- “বিল্ডিংয়ের কয়েক জায়গায় ফেটে গেছে। সরকার ওতে ঢুকতে নিষেধ করেছে। তারপরও মালিক আমাদেরকে ভেতরে যেতে বলছে। আমরা যাবোনা।” এই বলে চলে গেল। কয়েকজন শ্রমিক ভেতরে গিয়েও ফিরে আসছে।
আজ নাকি সবার বেতন দেওয়া হবে। ভেতরে গিয়ে বেতন আনতে হবে। আমরা দাবী তুললাম- বেতন দিলে বাইরে দেওয়া হোক। আমরা ভেতরে যাবনা। কিন্তু কর্মচারীরা তা মানছেনা। ভেতরে না গেলে নাকি বেতন দেওয়া হবেনা। অগত্যা আমরা ভয়ে ভয়ে ভেতরে গেলাম। তবুও সকলের মনে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ কোনও কথা বলছেনা। এমডি স্যার আসবে। তারপর বেতন দেওয়া হবে। এই বিল্ডিংয়ে কয়েকটা গার্মেন্টস আছে। সবগুলোতেই শ্রমিকরা ভীড় করছে এখন। বাইরেও কিছু আছে। তারা হয়ত ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছেনা।
বিল্ডিংয়ের ভেতরটা কেমন যেন গমগম করছে। আমরা ভেতরে ঢুকেছি বেশিক্ষণ হয়নি। এই যেমন ৫-৭ মিনিট। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। প্রতিদিনের মতই কয়েকটা ফ্লোরে জেনারেটর চালু করা হল। সাথে সাথেই আমার মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুড়গুড় শব্দে আমাদের মাথার উপর ভারী কিছু একটা পড়ল। বোধ হয় ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে। মানুষের আর্তনাদকে ছাপিয়ে চারিদিক থেকে শুধু চড়াৎ চড়াৎ আওয়াজ আসতে থাকল। কংক্রিটের ঢালাইকৃত ফ্লোর আমাদেরকে দ্রুত নিচের দিকে নিয়ে চলল। আমি চোখে শুধু একমূহুর্তের জন্য লাল-নীল-হলুদ একটা আলো ঝিকমিক করে উঠতে দেখলাম। এরপর ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধুপ্... করে একটা শব্দ হল কেবল। বাকি সব নিরব নিস্তদ্ধ। যেন মহাপ্রলয় ঘটেছে এতক্ষণ। এত কিছু ঘটে গেল মাত্র ৫ সেকেন্ড সময়ে। এরপর... আমি জ্ঞান হারাতে লাগলাম। কতোক্ষণ পর জানিনা। হাজার হাজার মানুষের আর্ত-চিৎকার ভেসে আসছে আমার কানে। ওরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। বাঁচাও-বাঁচাও বলে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমার পাশেই খানিকটা দূরে একজনের গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ওদিকে যেতে চাইলাম। কিন্তু নড়তে পারলাম না আমি। অনেক চেষ্টা করে। আমার পাশের ইট-সিমেন্টের টুকরোগুলো সরিয়েও আমি সেই আওয়াজটার দিকে যেতে পারছিনা। আমার দু পায়ের উপর পড়ে আছে ভারী কিছু। ডান রানের ভেতরে একটা লোহা ঢুকে গেছে। অনবরত রক্ত ঝরছে। নিজের অজান্তেই দু’চোখ ভিজে এল। যন্ত্রণায়। নাহ! আমি চিৎকার করছিনা। আমার মনে পড়ছে বাড়িতে থাকা বৃদ্ধা মায়ের কথা। আমি এখানে কেন! কী হয়েছিল! এক এক করে মনে পড়তে লাগল সব। কয়েক মুঠো ভাতের যোগাড় করার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম। পেটের তাগিদে। কিন্তু আমি না হয় মরেই যাব... আমার বৃদ্ধা মায়ের এখন কী হবে...।
প্রায় এক দিন পর... আমার আশেপাশের সকলেই বোধ হয় মরে গেছে। পঁচা গন্ধ বেরুচ্ছে। এরই মাঝে আমি কয়েকবার সংজ্ঞা হারিয়েছি। দুর থেকে কিছু মানুষের আওয়াজ ভেসে আসছে। চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ আর আহাজারি সব মিলিয়ে একাকার। উদ্ধারকারীরা বোধ হয় কাজ করছে। কিন্তু আমার চিৎকারে ওরা সাড়া দিতে পারছেনা। ধ্বসে পড়া দেয়ালের ফাঁক গলে মাঝে মাঝে ক্ষীণ আলো আসছে।
সময়ের হিসাব জানিনা। তবে মনে হয় কিছুক্ষণ পূর্বে বৃষ্টি হয়েছিল। ভেজা বালি-মাটির সোঁদা গন্ধ লাশ পঁচা বোঁটকা গন্ধকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই পিশাচপুরীতে আটকে থেকে যেন আমিও একটা পিশাচের রূপ নিয়েছি। তাই তো এতো গন্ধেও আমার বমি আসছেনা। তবে শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। আমি কয়েকবার চিৎকার করে আবার জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরেছে, দেখি- একদল উদ্ধারকর্মী আমার পাশের কংক্রিট আর বালুর জঞ্জাল সরিয়ে চলেছে। তারা আমাকে অভয় দিচ্ছে। আমি হতাশ চোখে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। কিন্তু ভগবান বোধ হয় এতে রাজি ছিল না। উপর থেকে একটা ভাঙ্গা পিলারের কয়েকটা অংশ পড়ল। দু’জন উদ্ধারকর্মী আহত হল। একটু পর ভেঙ্গে যাওয়া দেয়াল আর ফ্লোরের অনেকগুলো অংশ আমাকে ঢেকে ফেলল। আমার মাথাটা থেঁতলে গেল। যা কিছু রক্ত অবশিষ্ট ছিল তাও শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকল। আমার দু’চোখ বুজে আসছে ঘুমে। বার কয়েক খাবি খেয়ে আমার দেহটা চির নিদ্রায় ঢলে পড়ল। মা’গো... আমি আর পারলাম না...
▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒▓▒
কয়েকদিন পর...
রানা প্লাজার সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আর কোনও জীবিত মানুষ বা কোনও মৃতদেহের সন্ধান না পাওয়ায় সেনাবাহিনী কর্তৃক তা অপসারণ করা হয়েছে। এখন তা শুধুই অতিপ্রাকৃত বিরানভূমি। গভীর রাতে সেখান থেকে অনেক মানুষের “বাঁচাও-বাঁচাও” আর্ত-চিৎকার ভেসে আসে। সাধারণ মানুষ দিনের বেলায়ও জায়গাটা এড়িয়ে চলে। সেটা এখন একটা গা ছম্-ছম্ করা ভৌতিক স্থান। কারণ, সেখানে আটকে আছে পূজার মত অনেক শ্রমিকের অতৃপ্ত আত্মা।
___________________________________________________
উৎসর্গঃ সাভার ট্রাজেডিতে মর্মান্তিকভাবে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের।
লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): সাভার ট্রাজেডি, লাশ-কাহিনী ;
৩৪টি মন্তব্য
১.
২৮ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:০২
ডেনজারাসবয় বলেছেন:
সঝ্য করা কঠিন
লেখক বলেছেন:
কোনও ভাবেই সহ্য করা সম্ভব নয়
কোনও ভাবেই সহ্য করা সম্ভব নয়
ৎঁৎঁৎঁ বলেছেন:
++++++++++
লেখক বলেছেন:
অনেক ধন্যবাদ আপু
অনেক ধন্যবাদ আপু
সাউন্ডবক্স বলেছেন:
??? Ami vasahin.
লেখক বলেছেন:
এই ব্যাপারে কিছুই বলার ভাষা নেই
এই ব্যাপারে কিছুই বলার ভাষা নেই
s r jony বলেছেন:
ডেনজারাসবয় বলেছেন: সঝ্য করা কঠিন
লেখক বলেছেন:
মোটেই সহনীয় নয়
মোটেই সহনীয় নয়
রাফা বলেছেন:
এভাবে চলতে পারেনা।দিন দিন শুধু লাশের সারি দির্ঘ থেকে দির্ঘতর হোচ্ছে।
কোন কিছু বলার ভাষা নেই,ইখতামিন-ভাই।
কোন কিছু বলার ভাষা নেই,ইখতামিন-ভাই।
লেখক বলেছেন:
কিছু বলার শক্তিও নেই। ভাষাতো দূরের কথা..............
কিছু বলার শক্তিও নেই। ভাষাতো দূরের কথা..............
এসএমফারুক৮৮ বলেছেন:
বলার ভাষা নেই।
লেখক বলেছেন:
আমরা আসলেই কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি
আমরা আসলেই কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি
সেলিম আনোয়ার বলেছেন:
সুন্দর লিখেছেন ভাল লাগলো..................
মৃত্যু পুরী ..মানুষের হাহাকার সেখানে থাকবেই.....
এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।দেশের মানুষ ই দেশের ক্লান্তি লগ্ণে ঝাপিয়ে পড়ে।
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
মৃত্যু পুরী ..মানুষের হাহাকার সেখানে থাকবেই.....
এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।দেশের মানুষ ই দেশের ক্লান্তি লগ্ণে ঝাপিয়ে পড়ে।
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
লেখক বলেছেন:
অনেক ধন্যবাদ ভাই
আপনি ঠিকই বলেছেন
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই
আপনি ঠিকই বলেছেন
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
গিয়াসলিটন বলেছেন:
Ufffff! Mormantik!
লেখক বলেছেন:
অনেক মর্মান্তিক!!
অনেক মর্মান্তিক!!
ফারজানা শিরিন বলেছেন:
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন ভাল লাগলো..................
মৃত্যু পুরী ..মানুষের হাহাকার সেখানে থাকবেই.....
এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।দেশের মানুষ ই দেশের ক্লান্তি লগ্ণে ঝাপিয়ে পড়ে।
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
মৃত্যু পুরী ..মানুষের হাহাকার সেখানে থাকবেই.....
এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।দেশের মানুষ ই দেশের ক্লান্তি লগ্ণে ঝাপিয়ে পড়ে।
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
লেখক বলেছেন:
অনেক অনেক ধন্যবাদ!
হুম...
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ!
হুম...
দোষী ব্যক্তিরা যাতে সাজা পায় তার জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।তা না হলে এটি চলতেই থাকবেই।আর শত শত মানুষ এমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হবে।
এন এফ এস বলেছেন:
কিছু ভোট মানে এই পর্যন্ত ৩৯৭ টা ভোট ঝরে গেছে এটা একটা মামুলি বিষয় ।
লেখক বলেছেন:
তাতো বটে
তাতো বটে
এরিস বলেছেন:
কিচ্ছু বলার নেই।
লেখক বলেছেন:
হুম...
হুম...
লেখক বলেছেন:
আসলেই কিছু বলার ভাষা নেই.
সবাই যেমন আছে, ঠিক তেমনই আছি
তার উপর মনটা আজ সকালে আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল
আসলেই কিছু বলার ভাষা নেই.
সবাই যেমন আছে, ঠিক তেমনই আছি
তার উপর মনটা আজ সকালে আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল
রোেক্য়া ইসলাম বলেছেন:
ভাল লাগলো লেখাটা। রানা প্লাজা নামক মৃত্যুপুরির কিছু কথা।
আসলেই রানা প্লাজার ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আজ আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে গেছি কান আর মুখ থাকতেও আমরা বোবা কালা হয়ে গেছি। সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছি। জানিনা এভাবে আর কতদিন চলবে...............
আসলেই রানা প্লাজার ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আজ আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে গেছি কান আর মুখ থাকতেও আমরা বোবা কালা হয়ে গেছি। সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছি। জানিনা এভাবে আর কতদিন চলবে...............
লেখক বলেছেন:
লেখক বলেছেন:
তাই নাকি..
থ্যাংক্স
তাই নাকি..
থ্যাংক্স
লেখক বলেছেন:
হুমম.
হুমম.
সোহাগ সকাল বলেছেন:
এখনও মনে পড়ে, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে কতো মানুষ! কতো ভাই! কতো বোন!
লেখক বলেছেন:
আপনি ঠিক বলেছেন, সেই সব কাহিনী ভোলার নয়
আপনি ঠিক বলেছেন, সেই সব কাহিনী ভোলার নয়
আমি তুমি আমরা বলেছেন:
লেখক বলেছেন:
হুমম....
হুমম....